গণিতের ম্যাজিক : গণিতের রাজ্যে স্বপ্নের রাজকন্যা “লীলাবতী”
লীলাবতী শব্দটির অর্থ গুণসম্পন্না। গুণন এবং সূচকের সুশৃঙ্খল সরলীকরণে সুসজ্জিত, সমাধানের মত বিশুদ্ধ ও সঠিক, আর বচনামৃতের মতই মনোহর। একটি পুকুরের মধ্যস্থলে একটি জলপদ্ম ফুটিয়াছে। জলপদ্মটি পানির পৃষ্ঠদেশ হইতে এক ফুট উপরে। এমন সময় দমকা বাতাস আসিল, ফুলটি তিনফুট দূরে সরিয়া জল স্পর্শ করিল। পুকুরের গভীরতা নির্ণয় করো - লীলাবতী এই ধরনের প্রচুর অংক (সমস্যা) আমি আমার শৈশবে পাটিগণিতের বইয়ে দেখেছি বা সমাধান করেছি এবং অংকের (সমস্যা) শেষে লীলাবতী নামটি লেখা। তাহলে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে লীলাবতী মেয়েটি কে? তার সঙ্গে জটিল এসব অংকের সম্পর্ক কী?
বিভিন্ন গণিত বই ও ইন্টারনেট থেকে যা জানলাম তা হচ্ছে, সপ্তম শতকের বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ভাস্করাচার্যের একমাত্র কন্যার নাম “লীলাবতী”। ভাস্করাচার্যের নিষেধ করা সত্ত্বেও কিশোরী লীলাবতী তাকিয়ে আছে পানিভরা পাত্রের দিকে। চোখে তার অপার কৌতূহল। পাত্রের ভেতর একটি কাপ, তার তলায় একটি সূক্ষ্ম ছিদ্রের মধ্য দিয়ে কাপে পানি ঢুকছে। নির্দিষ্ট সময়পর কাপটি ডুবে যাবে এবং কিশোরী মেয়েটির বিয়ের জন্য সেটি হবে শুভ লগ্ন, আর তা নাহলে মেয়েটি বিধবা হয়ে থাকবে আজীবন। গণিতে পন্ডিত এবং শাস্ত্রজ্ঞ পিতা মেয়ের কোষ্ঠী (হিন্দু পরিবারে সন্তান জন্মের পর জ্যোতিষ শাস্ত্রী পারদর্শিদের মাধ্যমে তৈরিকৃত) বিচার করে ব্যাপারটি জানতে পেরেছেন। হঠাৎ মেয়েটির নাক থেকে একটি মুক্তোর দানা খসে পড়ল কাপের উপর, বন্ধ হয়ে যায় ছিদ্র। মেয়েটির কপালে বৈধব্যযোগ, এই অজুহাতে কন্যাসম্প্রদানের পূর্বেই বরপক্ষ মেয়েটির বিয়ে ভেঙে দেয়। মেয়ের কষ্ট দেখে পিতা ভাস্করাচার্যের হৃদয়ে অনেক কষ্ট লাগে। লীলাবতী যখন গভীর দুঃখে কাঁদছিল তখন ভাস্করাচার্য বললেন, ‘মা গো , তোমার জন্য কিছু করার সামর্থ্য আমার নেই, তবে পৃথিবীর মানুষ যেন বহু যুগ তোমাকে মনে রাখে আমি সেই ব্যবস্থা করছি। মেয়ে লীলাবতীর কষ্ট দূর করতে তিনি তাকে সন্ধান দেন এক বিশুদ্ধ অনুভূতির, মহান এক সৌন্দর্যের, বঞ্চনা আর হতাশার ঊর্ধ্বে প্রজ্ঞাময় জগতের সুশৃঙ্খল নিয়মের। তিনি লীলাবতীকে শিক্ষা দেন বিশুদ্ধ বিজ্ঞান শাস্ত্র গণিত বিষয়ে। আর মেয়ে লীলাবতীর নাম পৃথিবীতে অমর করে রাখার জন্য রচনা করেন বিখ্যাত গণিতের এক মহাকাব্য, “লীলাবতী”। সিদ্ধান্ত শিরমনি বইয়ের একটি খণ্ডের নাম লীলাবতী।
১১৫০ সালে বিশ্ব ইতিহাসে এক থমথমে শান্ত অধ্যায় শক্তিশালী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বে প্রকৃতির সমাহিত রূপের মতো। ইতিহাসের সেই শান্ত ক্ষণে পিতার মমতায় এবং গণিত শিক্ষা গ্রহণে অনন্য হয়ে উঠা কিশোরী লীলাবতী। লীলাবতী নামের মহাকাব্যটির রচয়িতা এই পৃথিবীর প্রাচীন মানমন্দিরের প্রধান আচার্য ভাস্কর (ভাস্করাচার্য)। আবার এটাও প্রচলিত আছে যে, ভাস্করাচার্যের মেয়ে লীলাবতী নিজেই লীলাবতী কব্যটি রচনা করেছেন।
লীলাবতী একটি কাব্যময় গণিত বই — ভাস্করাচার্যের “সিদ্ধান্ত শিরোমনি” গ্রন্থচতুষ্টয়ের প্রথম গ্রন্থ। তেরটি অধ্যায়ে রচিত পাটিগণিতের এই বইটিতে আলোচনা করা হয় আটটি গাণিতিক প্রক্রিয়া : যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, বর্গ, ঘন, বর্গমূল এবং ঘনমূল। গণিতের বিভিন্ন দিক যেমন শূন্যতত্ব,ঋণাত্মক সংখ্যা,করনী,বজ্রগুনন (আড়গুণন) ইত্যাদি বিষয় গুলো ফুটে উটেছে। লীলাবতী লেখার ধরণটা কথপকথন। কথা বলতে বলতে অঙ্ক শেখাচ্ছেন। এই প্রক্রিয়াগুলো ব্যবহার করে আসে
১. শূন্যপরিকর্মণ: শূন্যের ব্যবহার
২. ব্যস্তবিধি: ব্যস্ততার নিয়ম
৩. ইষ্টকর্ম: ঐকিক নিয়ম
৪. সংক্রমণ: (ক+খ) এবং (ক-খ) থেকে অপনয়ন পদ্ধতিতে ক ও খ এর মান নির্ণয়
৫. বর্গসংক্রমণ: (ক+খ) এবং (ক^২-খ^২) থেকে অপনয়ন পদ্ধতিতে ক ও খ এর মান নির্ণয়
৬. বর্গকর্ম: ক ও খ এর এরূপ মান নির্ণয় যাতে (ক^২+খ^২-১) এবং (ক^২-খ^২-১) পূর্ণবর্গ হয়
৭. মূলগুণক: বর্গমূল ও দ্বিঘাত সমীকরণ সংক্রান্ত সমস্যা
৮. ত্রৈরাশিকা: তিন-এর নিয়ম
৯. বন্দপ্রতিবন্দক: বিনিময় ব্যবস্থা
১০. মিশ্রব্যবহার: মিশ্রণের নিয়ম
১১. শ্রেণীব্যবহার: ধারার ব্যবহার
১২. অঙ্কপাশা বিন্যাস ও সমাবেশ
১৩. কুত্তক বা কট্টক: অনির্ণেয় সমীকরণের সমাধান
১৪. ক্ষেত্রগণিত: জ্যামিতি
লীলাবতী গ্রন্থে ভাস্করাচার্য ছন্দোময় ভাবে গণিত শিখিয়েছেন। লীলাবতী মহাকাব্যের অধিকাংশ সমস্যা ছন্দেমেয় কবিতার শ্লোকের মত হৃদয়গ্রাহী প্রাঞ্জল করে বর্ণনা করা হয়েছে। সাজানো হয়েছে রাজা, হাতি, পদ্মফুলের মত পরিচিত জিনিস দিয়ে, যাতে শিক্ষার্থীদের বুঝতে সুবিধা হয়। আর সেগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে লীলাবতীকে সম্বোধন করার মধ্য দিয়ে।
যেমন:
মৃগনয়না লীলাবতী বল দেখি পার যদি ১৩৫ গুণন ১২ কত হয় যদি তোমার জানা রয় গুণন প্রক্রিয়া, পৃথক অংশে আর পৃথক অংকে? এক ঝাঁক মৌমাছি উড়ে উড়ে যায় এক পঞ্চমাংশ কদম ফুলের মধু খায়। এক তৃতীয়াংশ গেল শিলিন্দের কুলে তাহার মনের আনন্দে কলকল করে। এই দুই সংখ্যার অন্তরের তিনগুন ক্রতুজা ফুলেতে সিল। বাকি এক মৌমাছি গুন গুন করিতে লাগিল। বল দেখি লীলাবতী মোট কয়টি মৌমাছি ছিল? হরিণ নয়না, চপলমতি লীলাবতী মনেমনে হিসাব করে উত্তর দিল পনেরটি।
প্রেমাবদ্ধ যুবতী হার ছিঁড়ে মুক্তো ঝরিল। তাহার এক ষষ্ঠাংশ মেঝেতে পড়িল। এক পঞ্চমাংশ মুক্ত রহিল বিছানায়। এক দশমাংশ থাকে যুবকের হাতে। তবুও ছয়টি মুক্তো থেকে যায় মালাতে বলোনা দেখি লীলাবতী,কন্যে আমার কতগুলি মুক্ত ছিল গলেতে তাহার? হরিণ নয়না, চপলমতি লীলাবতী মনেমনে হিসাব করে উত্তর দিল তিরিশটা মুক্তো ছিল।
লীলাবতী মহাকাব্যটি সুবিন্যাস, উন্নততর পদ্ধতি এবং নতুন বিষয়বস্তু লীলাবতীকে করেছে চিরজীবি, যুগ যুগ ধরে লীলাবতীর সৌন্দর্যে বিস্মিত, আনন্দে আপ্লুত করেছে গণিতানুরাগীদের হৃদয়। গণিতকে নিয়ে গেছে কয়েক ধাপ উপরে। গত নয়শত বছরে পৃথিবীতে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছু। আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্ব আমাদেরকে করেছে ডিজিটাল। কলম্বাসের দেখানো পথ ধরে আসা সোনাখেকোদের হাতে বিলুপ্ত হয়েছে তিন হাজার বছরের আ্যজটেক সভ্যতা, আটলান্টিকের এক তীর থেকে দলে দলে দাসদের তাড়িয়ে, নেওয়া হয়েছে পৃথিবীজুড়ে পত্রঝরার চন্দ্রকালয় নিজভূমে হারিয়ে গেছে কত আদি অধিবাসী এবং মাত্র কিছু বছর পূর্বে লিটল বয় নামের আণবিক বোমার আঘাতে হিরোশিমা নামের একটি শহরে মারা যায় অগণিত মানুষ। কিন্তু ভালোবাসাহীন এইসব কাহিনী সভ্যতার শাশ্বত গল্প নয়, শাশ্বত হচ্ছে সেই সব গত নয়শত বছর ধরে লীলাবতী নামের গ্রন্থটি যা দিয়েছে, বিশুদ্ধ গণিতের সৌন্দর্য; উন্মোচিত হয়েছে তাদের সামনে সৃষ্টিজগতের মমতাময় নিয়মের মধ্যে কাব্যময়তা খুঁজে পাবার ক্ষমতা রাখে সে সব গণিত প্রেমি মানুষের হৃদয়ে, যাতে নেই কোন অনুমান, কোন গ্লানি—ঠিক যেমনটি বলে সমাপ্তি টেনেছেন মহর্ষি ভাস্করাচার্য লীলাবতী উপাখ্যানের: আনন্দ এবং সুখে প্রকৃতই উদ্ভাসিত হচ্ছে জগত, তাদের জন্য যাদের গলা জড়িয়ে, আছে লীলাবতী–ভগ্নাংশ, গুণন এবং সূচকের।
লীলাবতী খণ্ডটি নিয়ে একাধিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। কেউ কেউ ধারনা করেন লীলাবতী ভাস্করের কোনো কন্যাই ছিলেন না। আর এক মতে, ভাস্করের স্ত্রীর নাম ছিল লীলাবতী। তাঁর স্মরণে তিনি বইটির নাম দেন। তবে বইয়ের নানা জায়গায় এমন কিছু সম্বোধন আছে যে অনেকে ভাবছেন লীলাবতী এক কাল্পনিক নাম। কোথাও বলেছেন - 'অয়ি বালে লীলাবতী', কোথাও সখে, কান্তে, বৎসে বলে সম্বোধন করেছেন।
তবে লীলাবতী যেই হোক না কেন এই অমর মহাকাব্যটি যে, গণিত শাস্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে বিরাট ভুমিকা রেখেছে তা সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করেন।
কোন মন্তব্য নেই
Please validate the captcha.